কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: ‘চাল কেটে ছেঁটে মিনিকেট নামে বিক্রি বন্ধ নয় কেন? দুই বছর পূর্বে উচ্চ আদালতের এই আদেশের কোনই প্রতিফলন ঘটেনি চালের বাজারে। চাল উৎপাদক মিলারগণ ও বিক্রেতারা বলছেন, ‘বাজারে যেহেতু ভোক্তার পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থানীয় ব্রান্ডের নাম মিনিকেট। তাই ভোক্তার চাহিদা মাথায় রেখেই চালের সরবরাহ হয় বাজারে’। কুষ্টিয়া কৃষি বিপণন ও বাজার তদারকি কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান বলছেন, ‘মিনিকেট নামে কোন চাল বাজারজাত করা যাবে না’ এবিষয়ে সরকার ইতোমধ্যে আইন পাশ করেছে। খুব শীঘ্রই এর প্রতিফলন বাজারে দেখা যাবে’।
সরেজমিন কুষ্টিয়ার চালের মোকাম খাজানগর ও পাইকারি চালের বাজার ঘুরে দেখা যায় প্রতিটা চালের গুদাম, আড়ৎ ও খুচরা দোকানে এখনও থরে থরে সাজানো মিনিকেট নামের চালের বস্তা বহাল তবিয়তেই সরবরাহ ও কেনা বেচা চলছে।
খাজা নগরের সৌদি রাইস মিনের মালিক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বাজারে ভোক্তাদের চাহিদা ধরে পাইকার আড়ৎদাররা মোকামের মিলারদের কাছ থেকে মিনিকেট, আটাশ, কাজলতা নামের ব্রান্ডের চাল সরবরাহ করতে বলে। আমরাও ওই চাহিদা মতো এসব জাতের চাল প্যাকেটজাত করে বাজারে সরবরাহ করি’।
কুষ্টিয়া পৌর বাজারের চাল ব্যবসায়ী মা ষ্টোরের স্বত্তাধিকার আহমেদ মঞ্জুরুল হক রিপন বলেন, ‘মিনিকেট নামের কোন ব্রান্ড প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করা যাবে না বলছে সরকার। কিন্তু বাজারে তো এর কোন প্রতিফলন নেই। যেহেতু কাস্টমারের কোন আপত্তি নেই বরং চেয়ে নিচ্ছে; তাই আমরাও ক্রেতার চাহিদা ধরে মোকাম থেকে মিনিকেট ব্রান্ডের চাল এনে বিক্রি করছি’। তাছাড়া মিনিকেট চাল বেচা যাবে না এমন কোন নিষেধাজ্ঞাও আমাদের দেয়নি প্রশাসন’।
কুষ্টিয়া কৃষি বিপণন ও বাজার তদারকি কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান বলছেন, ‘রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় সভায় এবিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। সেখানে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের বাস্তবায়ন, ২৮ বালাম, সুপার বালাম, নিরাশাল, সুপার জিরাশাল চাল মিনিকেট লেখা বা এরূপ বস্তায় লিখে বিক্রয় করায় ৫২ টাকা মূল্যের চাল ৬২ থেকে ৬৪ টাকা মূল্যে বিক্রয় রোধে করনীয় বিষয়ে আলোচনা হয়েছে’। খুব শীঘ্রই এবিষয়ে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে সুপারিশ করা হয়’।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের নভেম্বরে মিনিকেট চাল নিষিদ্ধের আদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের বেঞ্চ একটি রীট করেনে মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য চাল। তবে স¤প্রতি অনেক ব্যবসায়ী চালের খাদ্যগুণ নষ্ট করে কেটে বা ছেঁটে ভিন্ন নামে বাজারজাত বা বিক্রি করছে। এমনকি যে নামে চালগুলো বিক্রি হচ্ছে সে রকম ধান বাংলাদেশে উৎপাদনই হচ্ছে না।’
পুষ্টিগুণ নষ্ট করে বিভিন্ন অটোরাইস মিলে চাল কেটে বাজারজাত ও বিক্রি বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে চাল কেটে বা ছেঁটে পুষ্টিগুণ নষ্ট করে বাজারজাত বা বিক্রি করা বন্ধে গাইডলাইন তৈরির কেন নির্দেশ দেয়া হবে না রুলে সেটিও জানতে চাওয়া হয়েছে।
বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের বে এ আদেশ দেয়।
মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ জনস্বার্থে এই রিট করে। রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাইনুল হাসান।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য চাল। তবে স¤প্রতি অনেক ব্যবসায়ী চালের খাদ্যগুণ নষ্ট করে কেটে বা ছেঁটে ভিন্ন নামে বাজারজাত বা বিক্রি করছে। এমনকি যে নামে চালগুলো বিক্রি হচ্ছে সে রকম ধান বাংলাদেশে উৎপাদনই হচ্ছে না।’
এ নিয়ে এর আগে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। ওই প্রতিবেদন যুক্ত করে রিট করা হয়।
মিলে চাল ছেঁটে সরু করার অভিযোগ নিয়ে গত বছর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। তবে সে সময় কুষ্টিয়ার বিভিন্ন মিল মালিকরা দাবি করেন, তাদের জানামতে এমন কোনো মেশিন নেই যাতে মোটা চাল কেটে চিকন করা যায় বা চিকন চাল কেটে আরও সরু করা হয়।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের রিটে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, স্বাস্থ্য-সচিব, খাদ্য-সচিব, কৃষি এবং বাণিজ্য-সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, র্যাবের প্রধান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের পরিচালক, বিএসটিআই, রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ৭ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং অটোরাইস মিলস মালিক সমিতির সভাপতি বা সেক্রেটারিকে বিবাদী করা হয়।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘রুলের পাশাপাশি আদালত কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে। এগুলো হলো যেসব অটোরাইস মিল চাল কেটে বা ছেঁটে মিনিকেট, নাজিরশাইল চাল নামে বিক্রি করছে তাদের তালিকা দিতে বলেছে আদালত।’
এছাড়া চাল কেটে বা ছেঁটে উৎপাদনের কারণে জনগণের স্বাস্থ্য-ঝুঁকি আছে কি না এবং খাদ্যের পুষ্টিমান ক্ষতি হয় কি না সে সম্পর্কে গবেষণা প্রতিবেদন বা রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের দেখা মিললেও সরকারের হিসেবে, দেশে মিনিকেট ধানের কোনো আবাদ নেই। মোটা চাল মেশিনে চিকন করে মিনিকেট নামে বিক্রি করছেন মিল মালিকেরা। তবে চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে মিনিকেট জাতের ধানের আবাদ হয়।
চালের উৎস ও ধানের জাত নির্ণয়ের জন্য ২১টি জেলায় সমীক্ষা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
এই তালিকায় আছে যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, বগুড়া, নওগাঁ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা।
এসব জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চাল কোন কোন জাতের ধান থেকে তৈরি করা হচ্ছে- তা চিহ্নিত করা হবে। মাসখানেক আগে নেয়া এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার দায়িত্ব পেয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও পরিধান ইউনিটের (এফপিএমইউ) ১৩ জন কর্মকর্তা।
কুষ্টিয়ার মিল মালিকদের দাবি, কিছু ক্ষেত্রে মোটা চাল পলিশ করে মিনিকেট হিসেবে বাজারজাত করার ঘটনা ঘটছে। তবে দেশে মিনিকেটের প্রচুর আবাদও হচ্ছে। এই ধান থেকে পাওয়া চাল বাজারজাত করছেন মিল মালিকেরা।